AdSense

Monday, July 1, 2019

গ্যাসের দামে বড়ো লাফ

গ্যাসের দামে বড়ো লাফ
ছবি: ইত্তেফাক

গৃহস্থালি, শিল্পসহ সব শ্রেণির গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। প্রতি মিটার ঘনমিটার গ্যাসের গড় দাম ৭ টাকা দশমিক ৩৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাত্ গ্যাসের দাম এক লাফে গড়ে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে । দেশের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় হারের মূল্যবৃদ্ধি। এ দাম বৃদ্ধির ফলে বছরে সব গ্রাহকের অতিরিক্ত খরচ হবে আট হাজার ৬২০ কোটি টাকা।

এদিকে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক ও অন্যায্য বলছে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। আর ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ বলছেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি অনেক পণ্য ও সেবার দাম বাড়াবে। তবে নিরবচ্ছিন্ন এবং স্থিতিশীল চাপের গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চাহিদামতো চাপের গ্যাস নিরবচ্ছিন্নভাবে না পাওয়ায় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিতরণ কোম্পানিগুলো দামবৃদ্ধির সমান্তরালে সরবরাহে যত্নশীল হলে মূল্যহার বৃদ্ধিজনিত ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে যাবে। কিন্তু তা না হলে শিল্প-বাণিজ্য বড় ক্ষতির মুখে পড়বে।
গতকাল রবিবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুত্-জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বর্ধিত মূল্যহার অনুযায়ী, বাসাবাড়িতে ব্যবহূত গ্যাসের এক চুলার মাসিক বিল ৭৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৯২৫ টাকা হয়েছে। দুই চুলার মাসিক বিল ৮০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৭৫ টাকায়। অর্থাত্ উভয় ধরনের চুলাতেই ১৭৫ টাকা করে দাম বাড়ানো হয়েছে। আর গৃহস্থালিতে ব্যবহূত মিটারভিত্তিক প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৯ টাকা ১০ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৬০ পয়সা হলো।
দাম বৃদ্ধির সাম্প্রতিক হার-প্রবণতা বিবেচনায় এবারই সবচেয়ে বেশি হারে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে বিইআরসি। এ বছর প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ভারিত গড়ে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। এর আগে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই ধাপ মিলে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ভারিত গড়ে ২২ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিইআরসি। পরে প্রথম ধাপ কার্যকর হলেও আদালতের রায়ে দ্বিতীয় ধাপ বাতিল হয়ে যায়। তার আগে ২০১৫ সালের আগস্টে গ্যাসের দাম গড়ে ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ বাড়িয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। অর্থাত্ এবার সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় দামবৃদ্ধির ঘোষণা এলো গ্যাস খাতে। এর আগের দামবৃদ্ধির হারও ২০ শতাংশের আশেপাশে ছিল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
নতুন মূল্যহার প্রকাশে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে বিইআরসি চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি এবং বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে নতুন মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়েছে। যে দাম বেড়েছে তা গ্রাহকপর্যায়ে সহনীয় এবং বাস্তবসম্মত। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভোক্তার জন্য সুখবর এতটুকুই যে তারা আগে গ্যাস পেত না, এখন গ্যাস পাবে। তবে শিল্প গ্রাহক দাম দিলেও সঠিক গ্যাস পাচ্ছেন না—এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান বলেন, আমরা এজন্য মিনিমাম চার্জ তুলে দিচ্ছি। একই সঙ্গে সকল শিল্প গ্রাহক ইভিসি মিটার যেন পায় সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ সময় কমিশনের অপর তিন সদস্য রহমান মুরশেদ, মাহমুদউল হক ভূঁইয়া এবং মিজানুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তারা জানান, দেশীয় গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির পথে হেঁটেছে সরকার। গ্যাস না থাকা বা কম থাকার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি দামের গ্যাস উন্নয়নের জন্য জরুরি। তাই গ্রাহকপর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। আজ ১ জুলাই থেকে নতুন দামবৃদ্ধি কার্যকর হবে। অর্থাত্ পোস্টপেইড গ্রাহকরা জুলাই মাস থেকে নতুন মূল্যহারে বিল পরিশোধ করবেন। আর প্রিপ্রেইড গ্রাহকরা আজ থেকেই নতুন মূল্য অনুযায়ী টাকা রিচার্জ করবেন।
নতুন মূল্যহার অনুযায়ী, বিদ্যুত্ উত্পাদনে ব্যবহূত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩ টাকা ১৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। সার শ্রেণির গ্যাসের দাম ২ দশমিক ৭১ থেকে বেড়ে ৪ টাকা ৪৫ পয়সা এবং চা বাগানের গ্যাসের দাম ৭ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বেড়ে ১০ টাকা ৭০ পয়সা হয়েছে। শিল্প খাতের গ্যাসের দাম ৭ টাকা ৭৬ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৭০ পয়সা বেড়েছে।
প্রতি ঘনমিটার বিদ্যুতের জন্য গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪.৪৫ টাকা, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুত্ উত্পাদনের (ক্যাপটিভ পাওয়ার) জন্য প্রতি ঘনমিটার ১৩.৮৫ টাকা, সার কারখানায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটারের দাম পড়বে ৪.৪৫ টাকা। এছাড়াও, শিল্পে ব্যবহারের জন্য প্রতি ঘনমিটার ১০.৭০ টাকা, চা বাগানে ব্যবহারের জন্য প্রতি ঘনমিটার ১০.৭০ টাকা, বাণিজ্যিক খাতে হোটেল-রেস্টুরেন্টে ২৩ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে ১৭.০৪ টাকা ও সিএনজিতে ৪৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
গাড়িতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজির দাম প্রতি ঘনমিটার ৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বর্ধিত মূল্যের মধ্যে ফিড গ্যাসের মূল্য ধরা হয়েছে ৩৫ টাকা এবং অপারেটর মার্জিন পূর্বনির্ধারিত ৮ টাকাই রাখা হয়।
ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৯ দশমিক ৬২ টাকা থেকে ১৩ দশমিক ৮৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর বাণিজ্যিক খাতের হোটেল ও রেস্টুরেন্টে ব্যবহূত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৭ টাকা ৪ পয়সা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ টাকায়। তবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ব্যবহূত গ্যাসের আগের মূল্য ১৭ টাকা ৪ পয়সাই রয়েছে।
বিইআরসির হিসাব অনুযায়ী, আগামী এক বছর যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহূত হবে গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত মোট ব্যয় হবে ১৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। সে ব্যয় মেটাতে বর্ধিত দামে গ্যাস বিক্রি করে সরকার অতিরিক্ত ৮ হাজার ৬২০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করবে। যা বর্তমান আয়ের চেয়ে ৪৪ শতাংশ বেশি। জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে সংগ্রহ করা হবে ২ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। বাকি ৭ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা ভর্তুকি বা আর্থিক সহায়তা হিসেবে সরকারকে দিতে হবে।
তবে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, গণশুনানিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রমাণ হয়নি। এলএনজি আমদানির কারণে কোম্পানিগুলোর ব্যয় বাড়বে বলে যে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল তাও কোম্পানিগুলোর বর্তমান লাভ থেকে জোগান দেওয়া সম্ভব। আর ভবিষ্যতে জ্বালানির দাম বাড়বে বলে যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে তাও যৌক্তিক নয়। দুর্নীতি, চুরি বন্ধ এবং সিস্টেম লস কমালে গ্যাসের দাম বরং কমানো সম্ভব। হিসাবের মারপ্যাঁচে একটি গোষ্ঠীর পকেট ভরবে এবং সাধারণ জনগণের পকেট খালি হবে। এ দামবৃদ্ধি সেই অন্যায্য পরিস্থিতিই তৈরি করবে।
বিদ্যুতের দাম বাড়বে কি?
গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেলে বিদ্যুতের দামও বৃদ্ধি পায়। দেশে এখন ৫৭ দশমিক ৪৩ ভাগ বিদ্যুত্ গ্যাসে উত্পাদন হয়। গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে বিদ্যুতের উত্পাদন ব্যয়ও বাড়বে। তবে বিইআরসি মনে করছে, বেশি পরিমাণ গ্যাস পেলে পিডিবি গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে বেশি বিদ্যুত্ উত্পাদন করবে। অন্যদিকে তখন এলএনজি থেকে বিদ্যুত্ উত্পাদন কমে যাবে। সারা বছরের গড় হিসেব করলে এতে বিদ্যুতের উত্পাদন খরচ বাড়বে না। এমনকি বর্তমানে যে হারে দাম বেড়েছে তাতে অতিরিক্ত ভর্তুকিও দরকার হবে না।
এ প্রসঙ্গে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, এখানে তারা (বিদ্যুত্ উত্পাদকরা) সমন্বয় করে নিলে আমাদের আর দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন নাও হতে পারে। তবে তারা যদি মূল্য সমন্বয়ের প্রস্তাব দেয় তাহলে কমিশন সেই আবেদন বিবেচনা করবে।
 Ittefaq

No comments:

Post a Comment