AdSense

Thursday, July 25, 2019

তিন মিনিটে এক জন ডেঙ্গু আক্রান্ত

টানা তিন দিন রেকর্ড ভঙ্গ

তিন মিনিটে এক জন ডেঙ্গু আক্রান্ত

 রোগীতে সয়লাব হাসপাতাল, চিকিৎসা দিতে হিমশিম মশা মারার ওষুধ কাজ করছে না বলেই এত ডেঙ্গু রোগী :স্বাস্থ্যমন্ত্রী ২১ জুলাই রোগীর সংখ্যা ৩১৯ জন থাকলেও এরপর যথাক্রমে ৪০৮, ৪৭৩ ও ৫৬০ জনে দাঁড়িয়েছে
তিন মিনিটে এক জন ডেঙ্গু আক্রান্ত
ডেঙ্গু আক্রান্তরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সা নিচ্ছেন—ইত্তেফাক

ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই ক্রমেই ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। ধারণ করছে ভয়াবহ আকার। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগিতে ভরে গেছে হাসপাতালগুলো। প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, যা আগের রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছে। ২১ জুলাই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ৩১৯ জন। এরপরের তিন দিন রোগীর সংখ্যা যথাক্রমে ৪০৮, ৪৭৩ ও ৫৬০ জনে দাঁড়িয়েছে। চিকিত্সা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তাররা। জ্বর হলেই ডেঙ্গু আতঙ্ক নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন রোগীরা। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঠাঁই মিলছে না অনেক রোগীর।

সরকারি হিসাবে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে নতুন করে ৫৬০ জন ভর্তি হয়েছেন। এ হিসাবে প্রতি ৩ মিনিটে কোনো না কোনো হাসপাতালে নতুন করে একজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এ নিয়ে চলতি জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ৪২১ জনে দাঁড়াল। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ৩/৪ গুণ বেশি।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি বলেন, সিটি করপোরেশনের মশা মারার ওষুধ কার্যকর নয়। তাই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। অ্যাডিস মশা প্রতিরোধে আরো কার্যকর ওষুধ ব্যবহার করা উচিত।
গতকাল বুধবার দুপুরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের তিনি আরো বলেন, এখন ডেঙ্গুর ধরণ পাল্টে গেছে। তাই ডেঙ্গু মুক্ত থাকতে আরো কার্যকরী ওষুধের প্রয়োজন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মশা মারার ওষুধ পরীক্ষা করবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। কৃষি মন্ত্রণালয় মশার ওষুধ পরীক্ষা করে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বলা হলে তা ভেবে দেখা হবে।
এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে থাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে দেখা গেছে, ১০ হাজার ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপতালে ভর্তি আছেন। সারাদেশে যেখানেই ডেঙ্গু রোগী ভর্তি থাকুক না কেন তাদের সর্বোচ্চ চিকিত্সা সেবা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার আরেক গবেষণায় সাড়ে তিন লাখ ডেঙ্গু রোগী বাংলাদেশে আছে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জ্বর হলেই অনেকে বিভিন্ন হাসপাতালে যাচ্ছেন। তারা ভাবছেন ডেঙ্গু জ্বর। বাস্তবে তা নয়, এক্ষেত্রে তারা প্রাথমিক চিকিত্সা নিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেল্থ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে: ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৪৫ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৫৭ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১১ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৪৮ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৭৯ জন, বারডেম হাসপাতালে ৪ জন, রাজারবাগে পুলিশ হাসপাতালে ১৬ জন, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৫৫ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৬ জন এবং বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোতে ১৩৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে গাজীপুরের তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৪২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এখনো ১৪ জন ভর্তি আছেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৭১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ১৬ জন, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২৪ জন, যশোরের আড়াইশ’ বেডের জেনারেল হাসপাতালে ৫ জন, বরিশালের শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দুই জন চিকিৎসকসহ ৮ জন মারা গেছেন।
জানা গেছে, রাজধানীর হাসপাতালগুলোর কোনো ওয়ার্ড বা কেবিন ফাঁকা নেই। সিটও খালি নেই। বাধ্য হয়ে করিডোরে আলাদা সিট বসিয়ে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা দিনরাত সেবা দিচ্ছেন। সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তাররা। ডেঙ্গু রোগী সামলাতে অন্য রোগীদের চিকিত্সাসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। যেহেতু ডেঙ্গু জ্বরের প্রধান বাহক অ্যাডিস মশা, তাই এ মশা মারতে আগে থেকেই কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না—এমন প্রশ্ন তুলেছেন চিকিত্সকরাও।
এদিকে জ্বর হলেই ডেঙ্গু জ্বর কি না—তার পরীক্ষার হিড়িক পড়েছে হাসপাতালগুলোতে। তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছে শিশু নুসরাত জাহান রিয়া (৫)। শ্যামলীর ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যেই বড়ো ছেলে সানি (৯) ও বৃদ্ধা মাও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। পরিবারের তিন জনের ডেঙ্গু ধরা পড়ায় বিপাকে পড়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারটি। ঢাকা শিশু হাসপাতালের সাত নম্বর ওয়ার্ডের ১০ নম্বর বেডে ভর্তি রিয়ার বাবা রবিউল ইসলাম বলেন, মেয়ের জ্বর ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি, রক্তবমি ও নাক মুখ দিয়ে রক্ত আসে। ডাক্তাররা রাতে মেয়ের পালস পাচ্ছিলেন না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল, ডেঙ্গু হয়েছে। রক্তের প্লাটিলেট কমেছে। ডাক্তাররা এখন চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন।
ডেঙ্গু জ্বর হলে যা করতে হবে:
দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর ধরন পালটে গেছে। আগে যেমন তীব্র জ্বরের সঙ্গে গায়ে রেশ ওঠা, ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যেত, এবার সে সব লক্ষণ ছাড়াও অনেক রোগীই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। দেখা যায়, রোগীর রক্তের প্লাটিলেট খুব দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ফলে জ্বর হলে ঘরে বসে চিকিত্সা না নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিংবা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। জ্বর না কমা বা অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকা, বমি হওয়া, পেটে তীব্র ব্যথা, রক্তক্ষরণ, মাথা ধরা, চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা প্রস্রাব না হওয়া বা কম হওয়া, খুব বেশি দুর্বল হয়ে পড়া, নিদ্রাহীনতা ও আচরণের আকস্মিক পরিবর্তন ডেঙ্গু জ্বরের অন্যতম লক্ষণ।
অন্তঃসত্ত্বা, বৃদ্ধ, শিশু এবং ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, লিভার ও কিডনির রোগীরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাদের চিকিৎসায় বিশেষ নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। জ্বর হলে ডেঙ্গু টেস্ট করাতে হবে। একই সঙ্গে প্লাটিলেট কমছে কি না—সেটিও দেখতে হবে। জ্বর হওয়ার তিন দিন পর আবার ডেঙ্গু ও প্লাটিলেট টেস্ট করাতে হবে। প্লাটিলেট কমে এলে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে।

No comments:

Post a Comment